কবিতা ও গর্হিত আত্মহত্যা কবিতা ও আধ্যাত্মিক অপরাধ কবিতা ও কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার

দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু


কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার একজন আত্মবিধ্বংসী কবি ছিলেনÑ এ কথাটি উচ্চারিত হওয়া অনেক বিস্ময়কর এ জন্যে যে, বাংলা ভাষ্যে জীবনানন্দ দাশ-এর পরে যে ক’জন আত্মবিধ্বংসী কবির নাম উচ্চারিত হতে পারে, তা নিতান্তই অঙ্গুলিমেয়। জীবনানন্দ দাশ-কে আত্মবিধ্বংসী ধারার প্রাগর্থী কবি ধরে নিলে পরবর্তী যে সকল কবিদের সঙ্গে কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার-এর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হওয়ার দাবী রাখে তারা হলেনÑ আবুল হাসান, বিনয় মজুমদার, সাবদার সিদ্দিকী, বিষ্ণু বিশ্বাস, শোয়েব শাদাব, ফাল্গুনি রায়, অসীম কুমার দাস প্রমুখ। অকাল প্রয়াত কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার-এর জীবদ্দশায়ই তাঁর পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ (সুষম দৃষ্টিতে, প্রথম প্রকাশ- সেপ্টেম্বর ১৯৭৯, সংঘর্ষ: আলো-অন্ধকার, প্রথম প্রকাশ- ফেব্র“য়ারী ১৯৮৯, ছায়া শরীরীর গান, প্রথম প্রকাশ- ১৯৯৭, পাখীর রাজার কাছে, প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ২০০১, চিবোয় প্রকৃতি, প্রথম প্রকাশ- ২০০২, প্রবন্ধত্রয়ী, প্রথম প্রকাশ- ডিসেম্বর ১৯৮৯) একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ এবং দুই শত চৌত্রিশটি অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে রচনা সমগ্র বের হয়। ফলে কিশওয়ার-রচনা একত্র-পাঠের সুযোগ হওয়ায় নতুন করে পাঠকীয় জিজ্ঞাসা তৈরী হয়েছে অথবা গ্রহণ-বর্জন স্পৃহা ঘনবদ্ধ হয়েছে বিবিধ প্রযতেœ। সংঘর্ষ: আলো-অন্ধকার গ্রন্থে যে কবির শক্তিমত্তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, তৎপরবর্তী অসংখ্য রচনায় তা খন্ডিত এবং ক্রমে খর্ব হয়ে যেতে দেখি; বিশেষ করে হামদ, না’ত সহ অধিবিদ্যাকেন্দ্রীক কবিতাগুলো অনেক দূর্বল এবং গতানুগতিক। কিশওয়ার-এর রচনা সমগ্রে তাঁর কোনো গল্প সংকলিত হয়নি। ‘রানুর অন্তিম পাঠ’ শিরোনামক গল্পটি বাংলা কথা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বললে অত্যুক্তি হবে না। এ আলোচনায় কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার এর সকল রচনা এক পাশে রেখে তাঁর রচিত একটি মাত্র কবিতায় অনুধ্যায়ী হতে চাই এবং তৎপূর্বে আত্মবিধ্বংসী ধারণাটি ব্যাখ্যাত হওয়ার দাবী রাখে।

একজন্মে মানুষ কি কবিতা লিখতে পারে? মানুষ কবিতা লেখে মৃত্যুর পরে। Ñ অন্তরাত্মার এই অসহায়ত্ব ধারণ করে মানুষ কবিতা নির্মাণ আয়ত্ব করেছে, এ এক বিস্ময়কর বিষয়। আর সর্বাধিক বিস্ময়কর হলÑ মানুষ নির্মাণ করছে আত্মবিধ্বংসী কবিতা, আত্মা ও আত্মউন্মোচনের তীব্রতা থেকে। এ যেনো অলৌকিক কবিতা, লৌকিকতা অস্বীকার করে নয়, ত্রিশ দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার অত্যুজ্জ্বল প্রতিনিধিত্বই নয়, বরং পৃথক আত্মা নিয়ে পৃথক যুগ-চেতনা, ঐতিহ্যে, পান্ডিত্যে সণাক্তযোগ্য ও সয়ম্ভূ। আত্মবিধ্বংসী কবিতা লঘু-চেতা কোনো সন্নাসীতত্ত্ব নয়, আবার চূড়ান্ত বাউলীয়ানা অস্বীকার করে নয়; পান্ডিত্যপূর্ণ অথচ পান্ডিত্যে নুব্জ্য নয়। কবি যেনো মহাসমুদ্রে এঁকে দিচ্ছেন চিহ্ন-রেখা, বাতাসে দস্তখত দিতে দিতে পাখিদের দেহ হতে মধ্যাকর্ষণ চিরে দিচ্ছেন। এ কোনো সুখী সমৃদ্ধশালী একাডেমী শিক্ষিত মিস্ত্রিবিদ্যকের কবিতা নয়। যারা আত্মবিধ্বংসী তারা আত্মজিজ্ঞাসু। শুধু তত্ত্ব আর যুক্তি দাঁড় করিয়ে গৌণ কবিদের মত তাঁরা পরিতৃপ্ত নন, বরং জিজ্ঞাসা আরো তীব্র, আরো দৃঢ়মূল হয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, অনুভবের কেন্দ্রীয় উৎস হতে। অতৃপ্ত কবি মহাসমুদ্রে ছুঁড়ে দেন প্রশ্নবিদ্ধ সত্তার শলাকা। নিকটতম সূর্যকে হত্যা করতে চান অথবা নিজেই দৃশ্যমান হতে চান বিন্দু বিন্দু হয়ে নিজের কাছে। ঈশ্বর, নদীনালা, প্রজাপতি হত্যার মাধ্যমে বোধ করি কবি একসময় আত্মবিধ্বংসী হয়ে ওঠেন তাঁর রচনায়, কখনো কখনো নৈমিত্তিক জীবন যাপনেও। কবি যখন চূড়ান্ত সমর্পিতÑ একটা লাল বন পিঁপড়াকে হত্যার মাধ্যমেই যেন হত্যা করা হল সারাটা প্রাণীমন্ডলী। কবির বিরোধ তৈরী হয় যাপিত জীবন, রাষ্ট্র, ধর্ম, প্রথা, রাজনীতি, অর্থনীতি, অ-কবি, গৌণ কবি সঙ্গে। সর্বকালে, সর্বভাষায়ই গৌণ কবির আধিক্য ছিল, এখন তো এমনই যে কবিতা লেখার মত সহজ আর মরীরি কাজটুকু যেন দ্বিতীয়টি নেই। ‘দ্রষ্টাÑ সে তো কবির একটি সনাতন ও সাধারণ অভিধা; আত্মিক দৃষ্টি যাঁর নেই তিনি কি কবি হতে পারেন? পারেন না তা নয়; অনেকে শুধু রচনার নৈপুণ্যের বলে কবিখ্যাতি অর্জন করেছেন; ঈশপের ছন্দোবদ্ধ প্রকরণ লিখে লা ফঁতেন, সুবুদ্ধিকে আঁটো দ্বিপদীর চুড়িদার পরিয়ে আলেকজান্ডার পোপ।

এ পর্যায়ে পঠিত হতে পারে কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার-এর ‘অস্তিত্বের শ্লোক’ কবিতাটিÑ

আমাকে হত্যা করো
প্রভুর আদেশে।

হত্যার সময়
বধ্যভূমিতেÑ
প্রভু, মৃত্যুদন্ডে করে অভিনয়।

ঘাতক।
দর্শক।
আর নিহতের
কর্তিত মস্তক,

শূন্যে হয় জল-অনল
আলোকালো সন্ত-পাপী
অস্তিত্ব ধারক।

আমাকে হত্যা করো
প্রত্যাদেশে
প্রভুকে হত্যা করো
আমার আদেশে
আমিÑ প্রভু
প্রভুÑ আমি
প্রেমের-পালক।

হৃদয়ে তোমাকে পেলে
প্রেম;

প্রাণ দিতে প্রাণ নিতে
আর প্রাণহীন হতে
শূন্যে আরো শূন্য হই
সকল সময়।

অনেকার্থব্যঞ্জক এ কবিতাটি পাঠ শেষে উইলিয়াম ব্লেইক -এর ওসধমরহধঃরড়হ রং এড়ফ অথবা শেলির ‘কবি ঐশ্বরিক’ কথাটি হয়তো স্মরণ করা যেত, আইনাল হক বা আমিই ঈশ্বর এর যোগসূত্র তৈরীর মাধ্যমে সুফীবাদী কবিতা বলে সজ্ঞায়িত করলেও হয়তো যুক্ত-তর্কের সন্নিবেশন হত। তার চেয়ে বরং ফিরে যাওয়া যাক প্রারম্ভিকতায়। অর্থাৎ আত্মবিধ্বংসী কবিতা ধারণ করে আধুনিকতা, বিনির্মাণ, কিউবিজম, যাদুবাস্তবতা, উত্তরাধুনিকতা সহ ভাবরাজ্যের সবগুলো সূক্ষèরশ্মি। কিন্তু আপন অবস্থানে সে সর্বদা স্থিরচিত্ত এবং দৃঢ়মূল। এ যেনো এক প্রার্থনার পাথর, জগতের সমূহ পাপ নিরন্তর শুষে নেয়, মানুষেরা চুম্বন করে পাপ রেখে আসে; পাথর আরো কালো হয়, গোপনে ঋব্ধ হয়। আত্মবিধ্বংসী কবিতার স্বরূপ বিশদ ভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর ‘ভূমিকা: শার্ল বোদলেয়ার ও আধুনিক কবিতা’য়। বুদ্ধদেব বসু যদিও বোদলেয়ারকে কোথাও আত্মবিধ্বংসী বলে চিহ্নিত করেননি, কিন্তু আত্মবিধ্বংসী বিষয়ের বীজ এত সযতনে বপন করা যা সহজেই সংক্রমিত করেÑ  ‘প্রথম দ্রষ্টা তিনি, কবিদের রাজা, এ এক সত্য দেবতা’ কথাগুলো লিখেছিলেন শতবর্ষের ব্যবধানে কোনো পুস্তকপীড়িত প্রৌঢ় পন্ডিত নন, তাঁর মৃত্যুর মাত্র চার বছর পরে এক অজাতশ্মশ্র“ যুবক, তাঁরই অব্যবহিত পরবর্তী এক কবি, আর্তুর র‌্যাঁবো, তাঁর প্রথম সন্তানগণের অন্যতম।

... ‘আমরা অনুভব করি বোদলেয়ারের চিন্ময় সত্তা, হেমন্তের ঝোড়ো হাওয়ার মতো, বয়ে চলছে সেই যৌবনকুঞ্জের উপর দিয়েÑ কুঁড়ি ঝরিয়ে, বীজ ছড়িয়ে, ফুল ঝরিয়ে, মরা পাতার মত মরা ভাবনাগুলিকে উড়িয়ে দিয়ে কয়েকটি অকালপক্ক রক্তিম ফল ফলিয়ে তুলছে।’

... ‘অদৃশ্যকে দেখতে হবে, অশ্র“তকে শুনতে হবে’, ‘ইন্দ্রিয় সমূহের বিপুল ও সচেতন বিপর্যয় সাধনের দ্বারা পৌঁছতে হবে অজানায়’, ‘জানতে হবে প্রেমের, দুঃখের, উন্মাদনার সবগুলি প্রকরণ’, ‘খুঁজতে হবে নিজকে, সব গরল আত্মসাৎ করে নিতে হবে,’ ‘পেতে হবে অকথ্য যন্ত্রণা, অলৌকিক শক্তি, হতে হবে মহারোগী, মহাদুর্জন, পরম নারকীয়, জ্ঞানীর শিরোমণি। আর এমনি করে অজানায় পৌঁছানো।’  

কবি কিশওয়ার পৌঁছেছিলেন অজানায়, এ সাক্ষ্য নির্দ্বিধায় দেয়া যেতে পারে। শুধু কবিতায়ই নয়, ব্যক্তিজীবনেও দীর্ঘদিন ভূগেছেন সিজোফ্রেনিয়ায়। আমৃত্যু লালনও করেছেন।

পুনঃর্বার পঠিত হতে পারে ‘অস্তিত্বের শ্লোক’ কবিতাটি।

আমাকে হত্যা করো
প্রভুর আদেশে।

হত্যার সময়
বধ্যভূমিতেÑ
প্রভু, মৃত্যুদন্ডে করে অভিনয়।

ঘাতক।
দর্শক।
আর নিহতের
কর্তিত মস্তক,

শূন্যে হয় জল-অনল
আলোকালো সন্ত-পাপী
অস্তিত্ব ধারক।

আমাকে হত্যা করো
প্রত্যাদেশে
প্রভুকে হত্যা করো
আমার আদেশে
আমিÑ প্রভু
প্রভুÑ আমি
প্রেমের-পালক।

হৃদয়ে তোমাকে পেলে
প্রেম;

প্রাণ দিতে প্রাণ নিতে
আর প্রাণহীন হতে
শূন্যে আরো শূন্য হই
সকল সময়।


কেন কবিতাটি পুনঃপঠিত হল? ব্যাখ্যাদান হয়তো জরুরী, হয়তো জরুরী নয়। কিশওয়ার এর অধিকাংশ কবিতায় একই জিজ্ঞাসা বারংবার ঘুরেফিরে এসেছে এবং গভীর থেকে গভীরে পৌঁছার মধ্য দিয়ে কবিতায় এসেছে অনেকার্থদ্যোতনা। কিন্তু অনেক আলোচকরাই হয়তো চাইবেন কিশওয়ারকে অস্তিত্ববাদী কবি, মরমী কবি, সুন্নী কবি, বিনির্মাণবাদী বা উত্তরাধুনিক কবি ইত্যকার মুখস্থ শব্দরাজির মাধ্যমে সিদ্ধান্তের সনদ দিয়ে দিতে। কিন্তু চিহ্নিত না করেও যে কবিতা পাঠ বা কাব্যালোচনা সম্ভব এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ না করাটাও যে একটা কাজ এ বিষয়টি আমাদের বোধের অতীত রয়ে গেছে ঐতিহ্যগতভাবে। এখন জিজ্ঞাসা  তৈরী হতে পারেÑ আত্মবিধ্বংসী ধারণা কি কবিকে চিহ্নিত করার নিমিত্তেই উচ্চারিত হয়নি? উল্লেখিত হওয়া জরুরীÑ আত্মবিধ্বংসী শব্দটি নিজ হতে নিজে সংজ্ঞায়িত না হয়ে বা কোনো বিষয়কে সংজ্ঞায়িত না করে বরং বিষয়টিকে অনুধাবনের জন্য পদ্ধতিগতভাবে বোধের নিকটপ্রতিবেশী হতে সহায়তা করছে মাত্র। আত্মবিধ্বংসী কবিতায় কী কী উপকরণের  অস্তিত্ব নেই তাও বিশ্লেষ্য। ‘অদৃশ্যকে দেখতে হবে, অশ্র“তকে শুনতে হবে, ‘ইন্দ্রিয় সমূহের বিপুল ও সচেতন বিপর্যয় সাধনের দ্বারা পৌঁছতে হবে অজানায়। ফলে পাঠককেও ক্ষমতা অর্জন করতে হবে রচনার সঙ্গে সহযাত্রার। ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী’ এ জাতীয় আরামদায়ক, পরিকল্পিত, তৃপ্তিকর এবং গ্রামীণ আবহে ভরপুর কবিতা পাঠে যারা অভ্যস্থ তাঁদের অনুভবের মাপঝোঁকে আত্মবিধ্বংসী কবিতা জায়গা না হওয়ার বহুবিধ কারণ আছে। উত্তরাধুনিকতা চর্চার লক্ষ্যে কিংবা শুধুমাত্র কাব্যভাষা অর্জনের নিমিত্তে আত্মবিধ্বংসী কবিতা আঞ্চলিক শব্দে ভরপুর নয়, অর্ধবোধের ভেতর থেকে বাউল ঘরাণার বিনির্মাণও নয়, আরোপিত লোকপুরাণ, ধর্মীয় কিচ্ছা কাহিনী সহ সংস্কৃত, উর্দুসহ বিদেশী শব্দের বাহাদুরীও নেই তাতে। আর কী কী উপকরণ অনুপস্থিতÑ এ বিষয়ে আত্মবিধ্বংসী ধারণাটি অচেতন নয়, বিপর্যয় সাধনের মাধ্যমে সার্বিকভাবে সচেতন।

কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার এর কবিতায় একই জিজ্ঞাসা বারবার ঘুরে ফিরে উচ্চকিত হওয়ায় এখন কি জাক দারিদাকে অনুসরণ করে বলবÑ কবিরা শুধু পুনরাবৃত্তিই করেন। আমরা কি অলংকারশাস্ত্রজ্ঞদের মত বলতে পারিÑ পুনরাবৃত্তি হল লেখক হিসেবে চিহ্নিত বা সনাক্তযোগ্য হওয়ার সনাতন কৌশল! বরং স্মরণ করা যেতে পারেÑ ঞযব য়ঁবংঃরড়হং, ড়হপব ধংশবফ, ংববস হবাবৎ মড় ধধিু. মানবমনে যে জিজ্ঞাসা একবার উদিত হয় তা কখনোই হারিয়ে যায় না। হারিয়ে না যাওয়া বা হারিয়ে না-ফেলার বদলে কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার আমৃত্যু জিজ্ঞাসার ক্রমবর্ধন করেছেন, বিধায় তিনি আত্মপ্রচারিত গৌণ কবিদের মত সুখী সমৃদ্ধশালী হাজার হাজার নির্বোধের তালিকায় নিজকে অন্তর্ভূক্ত করেননি। তিনি মৌলিক কবি। তিনি কবি।

সংযোজন:
অমৃতপুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার হে ঘনবদ্ধ কবি...

‘পিতৃ-পৃথিবী ছেড়ে কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার প্রস্থান করেছেন।’ এ বাক্যটি আমাকেও একদিন নির্মাণ করতে হবে, ভাবিনি। আবার ভাবছি, আমার মৃত্যু হলে কী রকম শব্দ বিন্যাসে কবি কিশওয়ার এ বাক্যটি রচনা করতেন? কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের মৃত্যু সংবাদ শুনে ভার্থখলার বাড়িতে জমায়েত হয়েছেন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ফুল-ফল বিক্রেতা, কোরানে হাফিজ, মোহাদ্দেস সহ অনেকেই। স্টেশন রোডের মাংস বিক্রেতা কসাইটি যখন কিশওয়ারের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কলিমা পড়ছিল, মুহুর্তে মানুষটিকে একজন পিতার অধিক মনে হয়েছে কবি দিলওয়ারের। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কবি দিলওয়ার আমাকে বলেন- গত বুধবারও কিশওয়ার তোমার কথা আলাপ করেছে। আগামীকাল বাদ জোহর কিশওয়ারের নামাজে যানাজা। তার জন্য প্রার্থনা করো। তৎক্ষণাৎ মনে হলÑ সন্তানের দাফনা দিতে গ্রাম-ভার্থখলায় প্রাচীনতম সূর্য উঠিয়াছে। কে তুমি অমৃতপুত্র, অলৌকিক কবি? এ জিজ্ঞাসা নিয়ে ক্ষণিক দাঁড়িয়েছে নয়াবন্দরমুখী সুরমার জল। পূনঃর্বার মনে হয়, কীনব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের কিশওয়ার সূর্যকে শাসন করছেন এবং একসময় ব্রীজ ও বাজপাখি অতিক্রম করে মিশে যাচ্ছেন জিন্দাবাজারের কোলাহলে।

কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার মারা গেছেন কয়েক ঘন্টা হলো- আমি এখনো কোনো প্রার্থনা-বাক্য খুঁজে পাইনি। কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার মারা গেছেন কয়েক ঘন্টা হলÑ আমি এখনো তাঁর মৃত্যু সংবাদ বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে, স্রোতের মতো কয়েকটি লাইন আমাকে ছানবিন করে সয়ম্ভূ হয়Ñ

মরে গেলে, ঝরে গেলে
এ নাম স্মরণ করে
পাথরের ফুল ছুঁড়ে দিও।

দীর্ঘদিন আগে কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার এ চরণগুলো লিখে আমাকে একখানা বই উপহার দিয়েছিলেন। বছরখানেক আগে, যখন বাংলাদেশে যাই, স্ব-রচিত গ্রন্থখানি তাঁর হাতে তুলে দেয়ার মুহূর্তে লিখে দেই-

মৃত্যুর পরে
আমায় ভাসিয়ো জলে
স্থলের সৌরভ।

কিশওয়ারকে বলি- এতো মরে গেলে, ঝরে গেলে চরণগুলোরই বিনির্মাণ। কিশওয়ার হাসেন। তার হাসি সর্বদা স্বর্গীয়।

২.
কবি হিসেবে কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার কত-ভূম অতিক্রম করেছেন, সে বিষয়ে আপাতত অনুধ্যায়ী হতে চাই না। তবে তিনি যে বড় কবি, এ অনুভূতি দীর্ঘদিন ধরে স্থিত হয়ে আছে, গহন বোধে।। মনে পড়ছে, আশির দশকের শেষ প্রান্তে আমাদের শহরের ক্যাসেটের দোকানগুলোতে যখন কবিতার নামে নীরার শাড়িগুলো উড়তো, তেত্রিশ বছর কেটে গেল কিংবা কষ্ট নেবে কষ্ট... এ জাতীয় শ্লোগানচারিতায় সয়লাব; শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ছড়াকাররা যখন যত্রতত্র হট্টগোল করত তখন আমি এবং আমরা উন্নাসিক হই; কিশওয়ারের কবিতা পড়ে শুধু বিস্মিতই হই না তার বন্ধু ও পাঠক হয়ে উঠি। মনে পড়ে, কিশওয়ার-গ্রন্থের বিজ্ঞাপনের ভাষাটিও ছিল অত্যাশ্চর্য। সিলেটের বেশ ক’টি কাগজে একসাথে ছাপা হয়েছিল। ‘বেরিয়েছে, ত্রিকাল অন্বেষী কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের কাব্যগ্রন্থ সংঘর্ষ: আলো-অন্ধকার’। ঐ বয়সে মনে হয়েছিল, কিশওয়ার যদি একাই ত্রিকাল নিয়ে যান আমি তা হলে কোন কালের কবি হব? ত্রিকালদর্শী হব? আশির দশকের প্রান্ত প্রজন্মের রাগী আর ভরাট কণ্ঠের কবি হব? হায় স্মৃতি! আজ বড় কান্নাজাগানিয়া।

কুড়ি বছর আগে প্রথম যখন কবি কিশওয়ারের সঙ্গে আমার পরিচয়, তখন আলাপচারিতার বিষয় ছিল অস্তিত্ব, ধর্ম, মৃত্যু, যৌনতা, কবিতা...। বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন প্রযতেœ। ইমাম গাজ্জালী, স্পিনোজা, ফ্রয়েড, লাইবনিজ, গৌতম বৌদ্ধ থেকে শুরু করে কবি দিলওয়ার পর্যন্ত আলোচিত হয়েছেন।
আমি দেশ-দেশান্তরী হই প্রায় দেড়-যুগ হল। কবি কিশওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেলেও মাসে অন্ততঃ একবার আমাদের মধ্যে ফোনালাপ হয়েছে। ধর্ম, যৌনতা, কবিতা... সেই বিশ বছর আগেকার সমান বিষয়গুলোই ঘুরেফিরে এসেছে। বোধ করি ঐ একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালে তিনি আমাকে স্পষ্ট দেখতে পেতেন, আমিও তাঁকে অনুধাবন করতে সক্ষম হতাম। গত বছর সিলেটে যখন তার সঙ্গে দেখা হয়, শামস্ নূর এর প্রিন্টিং প্রেস থেকে বেরিয়ে বলি- চলুন, ভাল কোনও রেস্তোরায় বসি; রাতের আহার একসাথে করবো। জিন্দাবাজারে বিদ্যুৎ চলে যায়। কবি বলেন- রয়েল হোটেল কমদামী হলেও খাবার এবং বসার জায়গা ভাল। ঘরোয়া পরিবেশ। আলো-অন্ধকার আর জনস্রোত ঠেলে আমরা হাঁটতে থাকি এক পরাবাস্তব সড়কে। সামনেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গলি, রয়েল হোটেল দুই কাঁইকের পথ!

মৃত্যু, যৌনতা, কবিতা নিয়ে যতবার আমরা আলাপ করি, সমান বিষয় নতুন করে দ্যুতিত হয় এজন্যে যে, এ জিজ্ঞাসা প্রতিটি মানবের জন্য মৌলিক, চিরন্তন ও শাশ্বত। মৌলিক বিষয় কখনো ফ্যাকাশে হবার নয়। আমি স্মৃতি থেকে তার কবিতা উচ্চারণ করি-

আমাকে হত্যা করো
প্রত্যাদেশে
প্রভূকে হত্যা করো
আমার আদেশে
আমি প্রভূ
প্রভূ আমি
প্রেমের পালক।

আমি ইংল্যান্ডে বণিকবৃত্তি অথবা দস্যুবৃত্তি করি এবং ইতোমধ্যে তিন সন্তানের জনক হয়েছি শুনে কিশওয়ার বিস্মিত হন, আর আমি বিস্মিত হই, চরণগুলো নির্মাণের জন্য মানবমন্ডলী হতে কবি কিশওয়ারকেই নির্বাচন করেছে প্রকৃতি। আমরা ধূমপান করি; একটার পর একটা সিগারেট ছাই করি। দেহের উপর বড় অত্যাচার হচ্ছে, আমরা আফসোস করি। ‘আমার এ জীবন সন্ন্যাসীর থেতলে যাওয়া শিশ্নের মত’ অথবা ‘হায় হাওড়া ব্রীজ, লোহার ব্রেসিয়ার’। আত্মবিধ্বংসী কবি সাবদার সিদ্দিকীর কয়টি চরণ প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে। বন্ধুবর বদরুল হায়দার, সরকার মাসুদ প্রমুখদের জীবন বৈচিত্র নিয়ে কথা বলেন। কিশওয়ারের মতে, এরাও কম আত্মবিধ্বংসী নন।

আমি বলি- যারা অধূমপায়ী, বড় বেশি সামাজিক, স্বাস্থ্যবান তাদের রচনা পড়লেই স্থূলতা বুঝা যায়। প্রতিটি চরণই মনে হয় পূর্ব-পরিকল্পিত। তারা মূলতঃ কলিজা-চিপে নির্যাস নিংড়াতে জানে না। তাদের কবিতা ফ্যাকাশে; বাওতা বিস্কুটের মতো- না খাওয়া যায়, না ফেলা যায়। আমরা সমস্বরে হাসাহাসি করি। রয়েল হোটেলের পাতলা আলোয় তাঁর চোখ চিকচিক করে। বেয়ারা পানদান নিয়ে আসে। জর্দা মাখিয়ে এক খিলি পান খাওয়ার জন্য শুধালে কিশওয়ার বলেন- দিনে দশ বারোটি টেবলয়েড/ক্যাপসুল খেতে হয়। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দাঁতের জোর কমে গেছে। আমার বুক হো হো করে। মানুষের হাড়েরও ক্ষয় হয়! এতো হাড় নয়- কাঁটা খঞ্জর! কিশওয়ার বলেন, মৃত্যুর পরে আমার মনে হয় মানবের কোনও ক্ষয় নেই; শুধু মুক্তি, অবিরাম যন্ত্রণা থেকে। মৃত্যুর পরে শুধু ভোর আর ভোর, অনন্ত ভোর...

৩.
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ইস্পাতের গোলাপ’এর উপর একটি আলোচনা লিখেছিলেন কিশওয়ার এবং তা প্রকাশ করে পত্রিকার কপিটি কবি বন্ধু শামস্ নূর এর কাছে রেখে আসেন, যেন আমার হাতে এসে পৌঁছায়। সাক্ষাতে তাকে জিজ্ঞাসা করি আমার কবিতা প্রসঙ্গে। কিশওয়ার সময় নেন। যদিও তিনি স্বল্পভাষী, কিন্তু যখন বলতেন খনন করে কথা বলতেন। আমার কাছে যা ওহঃবহংরভরবফ ংঢ়ববপয. কিশওয়ার প্রতিউত্তরে বলেনÑ আপনার কবিতা সংক্ষিপ্ত এবং ক্ষুদ্রাকৃতির যা শক্তিমত্তা ধারণ করে আবার সীমাবদ্ধতাও লালন করে। আমি বলি- জৈষ্ঠ মাস, আষাঢ় মাসের বর্ণনা লিখে কবিতা এখন আর এই বয়সে এসে দীর্ঘ করা যায় না, এখন মহাবিশ্বকেই একটা সরষে দানার মতো মনে হয়, লাই বিছরায় বসে থাকা কালো পেচকুন্দা পাখিটির নাম হচ্ছে পৃথিবী। দীর্ঘ কী করে লিখবো!

এরকম ব্যাখ্যা কবি কিশওয়ারের জন্য তৈরী করতে ভাল লাগতো অথবা কিশওয়ারই আমাকে চিন্তার বহুব্যঞ্জণায় উদ্বুদ্ধ করতেন। যখন তিনি বলতেন যথার্থ শব্দ নির্বাচন করে বলতেন; বিধায় তাঁর আঞ্চলিক জবানীও আমার কাছে মনে হতো সর্বরাষ্ট্রিক, সর্বভাষিক এবং সর্বগৌত্রিক। তাঁর কাছে আমার শব্দ এবং চিন্তা-ঋণ অনেক।

স্বভাবে সন্ত, ঋষি প্রকৃতির এ লোকটির মাঝে পান্ডিত্যের কোনও বদহজম ছিল না। কোনও কথা বলার আগে অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে বলতেন। পান্ডিত্য নিয়ে যুদ্ধ কিংবা উল্মলম্ফের বদলে জানা-বিষয়কে অনুভূতির গভীর স্তরে নিয়ে যেতেন এবং যা বলতেন- নতুন এক সত্য মনে হত।

কবিতা লিখছেন?
কিশওয়ারের প্রতিউত্তর-
-লিখছি।
বেঁচে থাকার জন্য
কবিতাই আমার একমাত্র অবলম্বন।

৪.
(৯/১২/২০০৬) আজ বাদ জোহর কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারকে ভার্থখলাস্থ গোরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। আজ ইরাকের সালাউদ্দীন নগরীতে চল্লিশজন মানুষ বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছেন। পৃথিবীর সব মৃত্যুই যেহেতু সমান এবং মানব মাত্রই যেহেতু আমারই খন্ডাংশ, আমিও সবার কবরে শুয়ে আছি, সীমাবদ্ধতা হেতু এ দৃশ্য আপাতত অন্তরে দেখি না। বরং দেখি, লাল আসমানে কালো কালো বাঁশঝাড়গুলো উড়ছে আর বরাকের ঐপারে কুয়াশায় ভিজে যাচ্ছে ভার্থখলা গ্রাম। আমি শুয়ে আছি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের সমান সিন্দুকী কবরে। আমাদের মেদ, মাংস সব ঝরে যাচ্ছে আর মহাকালের ভেতর তিরতির করছে কয়গাছা শক্ত হাড় অথবা কিশওয়ারের কবিতা ও কঙ্কাল...