বিলাতে বাংলা কবিতা উৎসব ২০০৮ প্রসঙ্গে - আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
 

বিলাতে বাংলা কবিতা উৎসব, লন্ডন’ শীর্ষক কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে কুইন্সমেরী ইউনির্ভাসিটিতে কলেজে চব্বিশে আগষ্ট তারিখে। এর আগে বহু বছর ধরে সাহিত্য সম্মেলন হয়েছে। নাটোৎসব হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত ও শামসুর রাহমানকে নিয়ে আলোচনা সভা ও কাব্যসভাও হয়েছে বহুবার। কলকাতা ও ঢাকা থেকে বহু নামিদামি কবি সাহিত্যিক এসব সভাতেও বহুবার এসেছেন। বিলাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা লাভের সূচনা মূলত সত্তরের দশকে হলেও সম্ভবত তার জয়যাত্রার আরম্ভ আশির দশক থেকে।
এখন একুশ শতকের এই প্রথম দশকে ইস্টএন্ডের যেকোনো স্থানে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে বলা চলে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির তৃতীয় শক্তিশালী কেন্দ্র এখন লন্ডনই। এই অবস্থাটির জন্য ভবিষ্যতে নিউইয়র্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত নিউইয়র্কের অবস্থান চতুর্থ কেন্দ্র হিসেবে বলেই অনেকে মনে করেন। নিউইয়র্কেও এখন বড় বড় সাংস্কৃতিক সমাবেশ হয়। সেগুলো মূলত কালচারাল ফেস্টিভ্যাল। কিন্তু লন্ডনে বৈশাখী মেলার মতো বড় রকমের কালচারাল ফেস্টিভ্যালের সংখ্যা কম হলেও আয়োতনে ছোট লিটারারি ফেস্টিভ্যালের সংখ্যা অনেক বেশি। তার প্রমাণ লন্ডনে কেবল বাংলা কবিতাকে কেন্দ্র করে চব্বিশে আগষ্টের এই উৎসব। এই উৎসবকে বলা চলবে বাংলা কবিতার ত্রিবেণী সঙ্গম। ঢাকা ও কলকাতার সঙ্গে ইউরোপের বাংলা কবিতার প্রাণ প্রবাহের এখানে এক ধরণের মোহনা সৃষ্টি হতে দেখা যাবে। যার গতি ক্রমশঃই বেগবান হচ্ছে।
আমি যখন সত্তরের গোড়ায় লন্ডনে আসি, তখন বাংলা সাহিত্যের চারা বিলাতের মাটিতে মাত্র অঙ্কুর গজাতে শুরু কেেরছে। সংবাদপত্র বলতে সাপ্তাহিক জনমত। সাহিত্য পত্রিকা ছিলো না। হিরন্ময় ভট্টাচার্য্য পূর্ব লন্ডনের রেডব্রিজ থেকে ’সাগরপারে’ নামে একটি দ্বিমাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন। তিনি নিজেও ছিলেন কথাশিল্পী। তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের লন্ডন প্রবাসী কিছু কবি-সাহিত্যিক জড়িত ছিলেন।
বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক বলতে তখন হাতে গোনা কয়েকজনকে মাত্র চিনতাম। তার বিবিসি রেডিও’র বাংলা বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যেমন সৈয়দ শামসুল হক, সিরাজুর রহমান, কাদের মাহমুদ, মাহমুদ হাসান, শফিক রেহমান, তালেয়া রেহমান, শামিম চৌধুরী প্রমুখ।
বিবিসি’র বাইরেও কয়েকজন সাহিত্যিক সাংবাদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। যেমন একটি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন আবদুল মতিন ও আমির আলি। শিক্ষকতা করতেন সালমা নাসির ডলি ও সালেহা চৌধুরী। চিকিৎসার পেশায় ছিলেন ডা. কুদরতুল ইসলাম। এরা কবি এবং কথাশিল্পী দুই-ই। বার্মিংহামে থাকতেন ডা. মাসুদ আহমদ। পেশায় চিকিৎসক হলেও ছোটগল্প ও নাটক লেখা ও মঞ্চায়নে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। খ্যাতি অর্জন করেছেন। আশির দশকের দিকে এই গ্র“পে এসে যুক্ত হন কবি ও কথাশিল্পী শামীম আজাদ। পেশা শিক্ষকতা। এদের মধ্যে সালেহা চৌধুরী ও শামীম আজাদ ইংরেজিতেও কাব্য চর্চায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আরও পরে বিবিসি’র বাংলা বিভাগে ঢাকা থেকে এসে যোগ দেন ঊর্মি রহমান। তিনি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক দুই-ই। বাংলাদেশের আরও একজন আধুনিক কবি দীর্ঘকাল ধরে লন্ডন প্রবাসী। তিনি দেবব্রত চৌধুরী। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থই পাঠক প্রিয়তা অর্জন করেছিল।
আগেই বলেছি, আশির দশকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিশু চারাটি বিলাতে বেশ বড়সরো হয়ে ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। এর একটা বড় কারণ, এই সময় বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শিক্ষিত বাঙালি ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে বিলাতে আসতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন পেশায় যোগ দেন। প্রচুর ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করে বিলাতে উচ্চশিক্ষার জন্য তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি-সভ্যতাকেও। ফলে লন্ডন থেকে শুরু করে বিলাতের ছোটবড় নানা শহরে চীনা বসতির মতো বাঙালি বসতিও গড়ে ওঠে। চায়না টাউনের মতো বাংলা টাউনও গড়ে উঠেছে লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে। বাংলা সংবাদপত্রের সংখ্যা বেড়েছে। রেডিও টিভি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কবি নজরুল সেন্টার, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ব লন্ডনের শহীদ আলতাব আলী পার্কে একুশের ভাষা শহীদদের স্মরণে ঢাকার ভাষা শহীদ মিনারের অনুকরণে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
লন্ডন থেকে সাহিত্য সাময়িকিও বেরিয়েছে অনেক। কবিতা সংকলন অগুনতি বেরিয়েছে। তা ঢাকা বা কলকাতার কবিতা সংকলনের চাইতে খুব ন্যুনমানের নয়। লন্ডন থেকে একটি কবিতা-পত্রিকা বের করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন আশির দশকের একটু আগের কবি ফরিদ আহমদ রেজা। এছাড়া সাহিত্য সাময়িকি বেরিয়েছে নূরুল হোসেনের অভিমত. সুকুমার মজুমদারের প্রবাসী সমাচার, আকাশ ইসহাকের তৃতীয়ধারা। লন্ডনের বাংলা সাাহিত্য পরিষদও অনিয়মিত সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করছেন।
এ সকল পত্রিকার মধ্যে আমার দৃষ্টি সবচাইতে বেশি আকর্ষণ করেছিল তরুণ কবি ও সাহিত্যিক ফারুক আহমদ রনির সম্পাদিত ’শিকড়’ পত্রিকা। পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেণ লোকমান আহমদ, সাইফুদ্দীন আহমদ বাবর ও ফরিদা ইয়াসমিন জেসি। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ পর্যন্ত এই সাহিত্য সাময়িকিটি বাজারে চালু ছিল। শব্দপাঠ ও একটি ভাল সাহিত্য কাগজ। আতাউর রহমান মিলাদ ও আবু মকসুদের স¤পাদনায় বের হয়।
যেহেতু বিলাতে বাংলা কবিতা উৎসব উপলক্ষে এই নিবন্ধটি লিখছি, সেহেতু কবিতার প্রসঙ্গে ফিরে যাই। কথাশিল্পী, নাটক, প্রবন্ধ নিয়ে আরেকটি প্রবন্ধে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইলো। বিলাতে আশির দশক থেকে যে তরুণ কবিরা গড়ে উঠেছেন, তাদের মধ্যে রবীন্দ্র-নজরুল যুগের কাব্যধারার অনুসারী দু’একজন পাওয়া যাবে না তা নয়। কিন্তু অধিকাংশই ত্রিশের এবং উত্তর তিরিশের আধুনিক কাব্যধারার অনুসারী। জীবনানন্দ থেকে শামসুর রাহমান- ত্রিশের এবং উত্তর তিরিশের অনেক শক্তিশালী কবির প্রভাব তাদের অনেকের কবিতায় দেখা যায়। তাদের কবিতায় স্বদেশ এবং বিদেশের  চিন্তা চেতনার মিশ্রণ বাংলা কবিতাকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। যা এখনো পূর্ণ ও পরিণত চরিত্র পায়নি। কিন্ত পাওয়ার পথে।
আশির ও নব্বইয়ের দশকে বিলাতে যারা কবি হিসেবে যশ ও খ্যাতি কুড়িয়েছেন তাদের নামের তালিকা দীর্ঘ। আমি তাদের কয়েকজনের নাম নিচে উল্লেখ করছি। এদের অনেকের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আশির দশকের কবিদের মধ্যে আছেন আতাউর রহমান মিলাদ (কবি ও কথাশিল্পী দুই-ই), আবদুল মুখতার মুকিত, সাফিয়া জহির, ফারুক আহমদ রনি (কবি ও কথাশিল্পী দুই-ই), মাসুদা ভাট্টি (কবি ও কথাশিল্পী) আবু তাহের (মূলত ছড়া লেখক), দিনার হোসেন, দিলু নাসের (ছড়া), মাজেদ বিশ্বাস, রেজওয়ান মারুফ, বাসেরা ইসলাম রেখা, আহমদ ময়েজ, আবু মকসুদ, ইকবাল হোসেন বুলবুল, মাশুক ইবনে আনিস, দীনুজ্জামান, সৈয়দ শাহীন, সৈয়দ বেলাল আহম প্রমুখ।

নব্বইয়ের কবিদের তালিকাও ছোট নয়। শামীম শাহান, শাহ শামীম আহমদ, সুমন সুপান্থ, ওয়ালি মাহমুদ, ফরিদা ইয়াসমিন জেসি (কবি ও কথাশিল্পী), আনোয়ারুল ইসলাম অভি, শামসুল জাকি স্বপন, সাঈম চৌধুরী, দিলওয়ার হোসেন মঞ্জু এবং আরো অনেকে। এদের মধ্যে অনেক শক্তিশালী কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক এবং নাট্যকারও আছেন।
আমার লেখায় লন্ডনের কবি সাহিত্যিকদের এই নামের দীর্ঘ তালিকা দেওয়ার উদ্দেশ্য এই যে, একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মহাদেশে এবং ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতি সভ্যতার দেশে, সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহাওয়ায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এই যে দ্রুত শিকড় বিস্তার চলছে এটাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্যের শক্তি ও স¤প্রসারণশীলতার প্রমাণ বহন করে। বিকলাতে আজ বাংলা কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই উৎসব যে শুধু বিলাতে নয়, সারা ইউরোপে একদিন তার শিকড় ছড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। আমার বিশ্বাস ইংরেজি ও ফরাসী ভাষার সাম্রাজ্যের মতো সারা বিশ্বে একদিন বাংলারও ভাষা সাম্রাজ্য গড়ে উঠবে। বিলাতে এখন তারই শিকড়োদ্গম দেখছি।

লন্ডন, ১৮ আগষ্ট